চৌগাছা হাসপাতালের এক্সরে মেশিন দূর্নীতির তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা প্রকৌশলি! মেশিনটি ফেরৎ নিতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার চিঠি

0
416

জিয়াউর রহমান রিন্টু

যশোরের চৌগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্সরে মেশিন কেনার দূর্নীতির তদন্ত ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা প্রকৌশলি আব্দুল মতিনকে দূর্নীতি তদন্ত কমিটির প্রধান করায় নানা রকম প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
উপজেলা প্রকৌশলী যিনি এই পোর্টেবল এক্সরে মেশিন ক্রয়ের প্রাক্কলন তৈরি, তদারককারী কর্মকর্তা এবং কাজটির বিল তৈরির সাথে সম্পৃক্ত। তিনিই কিভাবে এই কাজের দুর্নীতি তদন্ত কমিটির আহবায়ক হলেন?
এবিষয়ে জানতে চাইলে নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলি এনামুল হক বলেন, অভিযুক্ত বিষয়টির সাথে সম্পৃক্তদেরকে তদন্ত কমিটিতে না রাখাই শ্রেয়। তবে যেহেতু তদন্ত কমিটি আগেই হয়েছে আর আমার আগের ইউএনও স্যার করেছেন। তাই এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে কমিটি রিপোর্ট দেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাবে। তদন্ত কমিটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত করবেন আশা রেখে তিনি বলেন কমিটি কি প্রতিবেদন জমা দেয় সেটা দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। মেশিনটি ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনে টেকনিক্যাল উপ-কমিটি করা যেত মন্তব্য করে নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন ক্রয় প্রক্রিয়ার নীতিমালায় যেভাবে ক্রয়ের কথা বলা হয়েছে সেগুলো অনুসরন করা হয়েছে কিনা সেগুলো সবই দেখা হবে।
অন্যদিকে গত ১১ জুলাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.লুৎফুন্নাহার পুরাতন ও ত্রুটিযুক্ত পোর্টেবল ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি ফেরৎ নিতে উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়েছেন । চিঠিটি ১২ জুলাই উপজেলা চেয়ারম্যানের দপ্তর রিসিভ করেছে।
চিঠিতে তিনি (ডা.লুৎফুন্নাহার) লিখেছেন ‘‘উপজেলা পরিষদ থেকে গত ২৯.০৬.২০২০ তারিখে একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরবরাহ করা হয়। মেশিনটি গ্রহন করে স্টোর কিপার স্টোরে রাখেন এবং মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (রেডিওগ্রাফি) মেশিনটি ঠিক আছে বলে জানান। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ জনবল (রেডিওলজিষ্ট) না থাকায় মেশিনটি পুরাতন তাহা বুঝা যাই নাই। পরে ০২.০৭.২০২০ তারিখে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) অধ্যাপক ডাক্তার নাসির উদ্দিন মেশিনটি উদ্বোধন করতে আসেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার। তিনি মেশিনটি দেখে বুঝতে পারেন যে মেশিনটি পুরাতন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.লুৎফুন্নাহার মনে করেন,“পুরোনো , ত্রুটিযুক্ত মেশিনে এক্সরে করলে সঠিক রিপোর্ট নাও আসতে পারে।’’
উল্লেখ্য চৌগাছা উপজেলার ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) বরাদ্দে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিনের কেনার জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই বরাদ্দে ঠিকাদার হাসপাতালে একটি পুরাতন ও ত্রুটিযুক্ত মেশিন সরবরাহ করেন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রের দাবি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন ও তার অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল বারীকে উৎকোচের মাধ্যমে ম্যানেজ করে পুরাতন একটি মেশিন রংচং করে প্যাকেজিং করে ২৯ জুন অর্থবছরের একেবারে শেষ মুহুর্তে হাসপাতালে সরবরাহ করেন। হাসপাতালের স্টোর কিপার ও এক্সরে মেশিন অপারেটর সেটি প্যাকেজিং অবস্থায় গ্রহন করেন।
গত ২ জুলাই স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) অধ্যাপক ডাক্তার নাসির উদ্দিন মেশিনটি উদ্বোধনের সময় বুঝতে পারেন মেশিনটি রংচং করা এবং পুরোনো। পরে এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদুল ইসলাম তড়িঘড়ি করে ৫ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং ৫ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেন। সেই তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিনকে। তার সাথে সদস্য করা হয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ এবং বিআরডিবির প্রকল্প কর্মকর্তা (পজিপ) আনিছুর রহমান তালুকদারকে। এই তদন্ত কমিটি গঠনের ৯ দিন পার হলেও কোন তদন্ত করেননি।
উপজেলা প্রকৌশল অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে যশোরের চৌগাছায় ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) অর্থের স্বাস্থ খাতের বরাদ্দ থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ এপ্রিল-২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে মোতাবেক চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন ৪ জুন দরপত্র গ্রহণের শেষ তারিখ নির্ধারণ করে ১৬ ই মে দরপত্র আহবান করেন। তবে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি যাচাই করে দেখা গেছে ‘‘এডিপি/২০১৯-২০, চৌগাছা-১১’’ প্যাকেজ নির্ধারণ করে কাজের নাম লেখা হয়েছে ‘‘উপজেলা হাসপাতালে পোর্টেবল এক্সরে মেশিন ক্রয়’’। প্রাক্কলিত মূল্য লেখা হয়েছে সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা। কিন্তু সেখানে কোন মডেলের এক্সরে মেশিন অথবা নতুন বা রিকন্ডিশনড কিছুই লেখা হয় নি।
জানা গেছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) আওতায় উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলীর নেতৃত্বে উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের সাথে যোগসাজোসে এসব প্রকল্পগুলি নামকাওয়াস্তে সম্পন্ন করে টাকা তুলে নিয়েছেন।
জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলি আব্দুল মতিন বলেন,বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল কমিটি হয়েছে। আমি কমিটির অন্য দুসদস্যের সাথে কথা বলেছি। তারা বিভিন্ন কাজে ব্যবস্ত থাকায় আমি আজকে হাসপাতালে গিয়ে উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.লুৎফুন্নাহারের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা বলেছি। দুএক দিনের মধ্যে আমি রিপোর্ট পেশ করবো বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান বলেন এই এক্সরে মেশিনের পুরো ক্রয় প্রক্রিয়াটিই অস্বচ্ছ। এখানে ক্রয় প্রক্রিয়ার সর্বময় ক্ষমতা উপজেলা পরিষদের। উপজেলা প্রকৌশলী নিজে এডিবির প্রাক্কলন তৈরি, কাজ তদারককারী ও বিল প্রদানকারী কর্মকর্তা। তার দায়িত্ব মেশিনটি বুঝে নিয়ে হাসপাতালে হস্তান্তর করা। তিনি সেটা করেন নি। আবার তিনিই এই কাজের দুর্নীতির তদন্ত কমিটির আহবায়ক হন কি করে? তাছাড়া বর্তমানে একটি পোর্টবল এক্সরে মেশিনের বাজার মূল্য ১৪ লক্ষ টাকার উপরে। সেখানে মাত্র সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়ার সময়ে বা প্রাক্কলন তৈরির সময়ে উপজেলা প্রকৌশলী বিষয়টি কেন দেখেন নি বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন নি?