ডি এইচ দিলসান : ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরর আগে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে যশোরের মুক্তিকামী মানুষ, উত্তাল যশোরে সেদিন পাক বাহিনীর বিপক্ষে মাঠে নামে, সেই গন জুয়ারে নীর্বিচারে গুলি করে হানাদার বাহিনী। আর সেই গুলিতে যশোরের প্রথম শহীদ হন চারুবালা কর। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত সেই শহীদের স্মৃতি স্তম্ভ নির্মান করতে পারিনি কেউ, অযতেœ অবহেলায় চারুবলার কবের উপর দিয়ে এখন উঠেছে দখলদারদের প্রাচির, পড়ে আছে কিছু পুরানো পলেস্তার আর ভাঙ্গা ইটের স্তুপে। প্রায় বিলিন হতে চলেছে শেষ চিহ্নটুকুও। দখল হয়ে গেছে সমাধির আশপাশের জায়গাও। তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে যশোরের কোন সংগঠন পালন করে না। অথচ তার মৃত্যুর পর যশোর অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার দাবিতে মানুষ মাঠে নেমেছিল। সেই দিনটির কথা কেউ মনে রাখেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ উপ্ত হয়েছিলো চারুবলা করের লাশের উপর দিয়ে।
সরজমিনি গিয়ে দেখা গেছে নীলগঞ্জ মহাশ্মসানের পাশে নদীর ধারে প্রগতী বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে মাটির সাথে মিসে আছে চারুবালা করের কবরটি, যার উপর দিয়ে বাড়ি তুলেছেন নীলগঞ্জ এলাকার জসীমের ভাই। এক পাশে শুধু এক লাইন ইটের সারি ছাড়া আর কিছুই নাই সেখানে। শেষ চিহ্নটুকুও আর নেই সেখানে।
অনুসন্ধানে জানা যায় ৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টা। স্বতঃস্ফূর্ত জনতার বিশাল মিছিল বের হয় ঈদগাহ ময়দান থেকে। দড়াটানা মোড় ঘুরে কাপুড়িয়াপট্টি-চৌরাস্তা হয়ে মিছিলটি ঢোকে রেল রোডে। সেদিন সেই মিছিলে ছিলেন, বিএলএফ প্রধান আলী হোসেন মনি, জাসদের সহ সভাপতি রবিউল আলম, রওশন আলী, একরাম-উদ-দৌলাসহ আরো অনেকে। মিছিলটি সরকারী খাদ্য গুদামের সামনে পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থান দেখে তাদের দিকে ইট ও জুতা নিক্ষেপ করে উত্তেজিত জনতা। ওই সময় এক পাকসেনা বিক্ষুব্ধ জনতাকে ভয় দেখাতে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে, গুলিবিদ্ধ হয় আকাশে ভেসে বেড়ানো এক চিল। মৃত চিলটিকে নিয়ে মিছিলটি ঢোকে ভোলা ট্যাঙ্ক সড়কে। সার্কিট হাউসের ভেতরে পাক সেনাদের দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে জনতা। তারা সার্কিট হাউস আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক শহীদ মশিয়ুর রহমান বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে যান ঈদগাহ ময়দানে। বিভিন্ন মহল্লা থেকে বিক্ষুব্ধ মানুষ তখনও জড়ো হচ্ছিল সেখানে। এর পর দুপুর ১২টার দিকে হানাদার বাহিনীর গাড়ি ঈদগাহের পাশের রাস্তা অতিক্রম করার সময় জনতা আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জনতার দিকে অস্ত্র তাক করে হানাদাররা। নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে শান্ত হয় জনতা। ওই সময় খবর আসে টেলিফোন ভবন দখল করে নিয়েছে হানাদার বাহিনী। চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মধ্যে, উত্তেজিত ছাত্র-জনতার একটি অংশ ঈদগাহ ময়দান থেকে বেরিয়ে টেলিফোন ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এ সময় কোন পূর্ব সতর্কীকরণ ছাড়াই টেলিফোন ভবনের ছাদ থেকে জনতার দিকে মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে হানাদার বাহিনী। টেলিফোন ভবনের পশ্চিম পাশে বসবাস করতেন নিঃসন্তান পূর্ণ চন্দ্র কর ও তার স্ত্রী চারুবালা কর। হানাদার বাহিনীর ছোঁড়া বুলেট ঘরের গোলপাতার ছাউনি ভেদ করে বিদ্ধ হয় চারুবালা করের ঘাড়ে। শহীদ হন তিনি।
হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে আহত হন অনেকে। চারুবালা করের মরদেহ নিয়ে রাখা হয় যশোর সদর হাসপাতাল মর্গে। মর্গে তালা লাগিয়ে পাক সেনারা অবস্থান নেয় সেখানে। বাইরে হাজার হাজার মানুষ চারুবালা করের মরদেহ নেয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু পাক সেনারা মরদেহ দিতে নারাজ। অপেক্ষমাণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করে। ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে মানুষ। এমন সময় মশিয়ুর রহমান মুখোমুখি হন পাক সেনা অফিসারদের। বজ্রকণ্ঠে তিনি বলেন, আমার মায়ের মরদেহ আমি নিয়ে যাব, তোমরা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। মুহূর্তে জনতা মর্গের তালা ভেঙ্গে বাইরে নিয়ে আসে চারুবালা করের মরদেহ, সূর্য তখন অস্তগামী, সৎকারের জন্য শহীদ চারুবালা করের মরদেহ নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটছে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে, শবযাত্রায় পুরুষের সঙ্গে যোগ দেয় বহু নারী। সবার চোখে মুখে প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। নীলগঞ্জ মহাশ্মশানে সমাধিস্থ করা হয় শহীদ চারুবালা করের মরদেহ।
তৎকালিন বিএলএফ প্রধান আলী হোসেন মনি বলেন, সেদিন আমাদের মিছিলে হানাদার বাহিনী নির্বীচারে গুলি বর্ষণ করে, আহত হয়ে আমার অনেক সহযোদ্ধা, নিহত হয় চারুবালা কর। তিনি বলেন, স্বাধীনতার এতটা বছর পার হয়ে গেলো কিন্তু আমাদের সরকার, আমাদের নেতারা কেউ এগিয়ে এলোনা এই ছোট্ট একটা কাজে। তিনি সরকারের কাছে নিবেদন করেন, শহীদ চারুবালা করের স্মৃতিস্তম্ভটি দখলদারদেও কবল থেকে মুক্ত করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করতে।
এ ব্যাপারে জাসনের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছি যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালা করের সমাধীস্থলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে, তার জন্য আমরা বীগত সকল জেলা প্রশাসকের দারস্থ হয়েছি, কিন্তু কোন রকম সাহায্য পাই নি। তবে তিনি বলেন, খুব শিঘ্রই আমরা স্মৃতিস্তম্ভটি করবো।
সেদিনের মিছিলে ছিলেন যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও ম্যাগপাই নিউজের সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব কবির, তিনি বলেন, জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি, আমাদেও মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে এক এক জন চারুবালা। চারুবালা এ জেলার প্রথম শহীদ, যিনি দিয়ে গেছেন আমাদের একটি স্বাধীন দেশ, আর আমরা তার জন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ কেন দিবো না।
তিনি বলেন, যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালার স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে হবে। তিনি অবিলম্বে দখলদারদের উচ্ছেদ করে চারুবালা করের সমাধিটি স্মৃতিস্তম্ভে রুপ দিতে চান।
এ ব্যাপারে যশোর সংবাদ পত্র পরিষদের সভাপতি ও দৈনিক কল্যানের সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা একরাম-উদ-দৌলা বলেন, আমি ব্যাক্তিগতভাবে বহুবার চেষ্টা করেছি, এমপি, মন্ত্রী, জেলা প্রশাসক এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছে ধন্না ধরেছি, কিন্তু পরিতাপের বিষয় কেউ চারবালা করের স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মানে এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, অবিলম্বে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মান করতে হবে।
কথা হয় ওই এলাকার সিরাজুল ইসলাম মৃধা ও মোঃ হুসাইনের সাথে, তারা বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু সুনেছি স্বাদীনতা যুদ্ধেও গল্প, তাদের দাবি দেশের প্রথম শত্রæমুক্ত জেলা যশোরের প্রথম শহীদ চারুবালা করের স্মৃতিস্তম্ভটি সংস্কার করে আগামী প্রজন্মেও কাছে তুলে ধরতে।
এ ব্যাপারে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রওশন ইকবাল শাহী বলেন, আমরা পৌর মেয়রের সাথে কথা বলেছি, তিনি আশ্বাস দিয়েছেন খুব দ্রæতো তিনি চারুবালা করের সমাধীটি দখলমুক্ত কওে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হবে। তিনি বলেন আমরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চারুবালা করের স্মৃতি ধরে রাখতে কাজ করে যাবো।
এ ব্যাপারে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানের সাধারণ সম্পাদক যোগেশ দত্ত বলেন, আমি বিগত ২৪ বছর ধরে এই শ্মশানের দায়িত্বে আছি, এই পর্যন্ত চারুবালা করের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর ৫টি ফাইল দিয়েছি, ধন্না ধরেছি মুক্তিযোদ্ধা সংসদে, গিয়েছি এম, মন্ত্রীদের কাছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি, তিনি বলেন, আগামী প্রজন্মকে এই চারুবালা কে ছিলেন সেটা জানানোর জন্য হলেও একটি স্মৃতি স্তম্ভ করা দরকার।
এ ব্যাপারে নীলগঞ্জ মহাশ্মশানের সভাপতি অশিম কুন্ডু বলেন, চারুবালা কর বাংলাদেশের মানুষের কাছে হিন্দু নয়, মুসলিম নয়, বেীদ্ধ নয়, খ্রিস্টান নয়, তিনি একজন শহীদ হিসেবে পরিচিত। হাজার হাজার মানুষ সেদিন তাকে মিছিল সহকারে এনে সমাধি করা হয়। আমরা এ যাবৎ অনেক জেলা প্রশাসককে এনে দেখিয়েছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের এনছি, কেউ তার স্মৃতিস্তম্ভটি সংরক্ষন করা হয়নি। তিনি বলেন, সরকারি খাস জমি হওয়ায় প্রভাবশালীরা দখল করে চারুবালা করের বুকের উপর দিয়ে বাড়ি ঘর নির্মান করছে। তিনি বলেন এ যাবৎকালে সম্মেলিত সাংস্কৃতিক জোন একবার মাত্র সেখালে মোবাতি প্রজ্জ্বলন করে। তিনি বলেন আমরা শ্মশানের পাচিল দেওয়ার পরে সমাধিটি পাচিলের বাইওে পড়ে যায়, আর যার কারনে সমাধিটি ভুমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে। তবে তিনি বলেন, আমরা আমাদের শ্মশানে একটি ছাত্রবাসের নাম দিচ্ছি চারবালা কর ছাত্রবাস। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, এম, মন্ত্রীদেও কাছে আমরা দেছি, বার বার তাদেও কাছে গেছি, কিন্তু কইে এ ব্যাপারে কোন কাজ করেনি।